আমার বঙ্গবন্ধু - পর্ব তিন (3)

১১ ডিসেম্বর ১৯৭১ এর দিনটি ছিল রবিবার। ভোরে আমাদের বাড়ির পূর্বে পুকুরের ঐ পাড়ের বিস্তৃত ফসলের ক্ষেতের পিছন থেকে সূর্যটা ঠিকই উঁকি দিল। চড়ুই পাখির কিচির মিচির ডাকা ডাকিতে ঘুম ভাঙলো আমার। অবাক হয়ে সব কিছু দেখছি। নতুন সকাল! সূর্য উঠেছে! পাকিস্তানিরা বাড়ি আক্রমণ করেনি। অথচ গতকাল দশ ডিসেম্বর ১৯৭১ এ অভাবনীয় নিদারুণ মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করেছে বাড়ির প্রতিটি মানুষ। আল্লাহ্ পাক যেন নিজের ইচ্ছায় আমাদেরকে রক্ষা করেছেন। আল্লাহ্তায়ালার কাছে লক্ষ- কোটি শুকরিয়া!!!

আমাদের বাড়ির দক্ষিণ দিকেও ছিল বিস্তীর্ণ ফসলের ক্ষেত এবং তারপরেই তিতাস নদী। তিতাস নদীটি পূর্ব থেকে বয়ে এসে পশ্চিমে বেশ কিছু দূর গিয়ে মেঘনা নদীর সাথে মিশেছে। বাড়ির সীমানা থেকে তিতাস নদীর উওর পাড়ের দূরত্ব আনুমানিক এক মাইল হবে। তিতাস নদীর দক্ষিণ পাড় ঘেষেই গেছে সিলেট রোড। সিলেট রোডটি কুমিল্লা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে কুট্টাপাড়া নামের জায়গায় এসে তিন রাস্তার মোড় তৈরী করেছে সরাইলের রাস্তার সাথে। অর্থাৎ কুট্টাপাড়া মোড় থেকে উত্তর দিকে গেছে সরাইল এর রাস্তা, দক্ষিণ দিকে গেছে কুমিল্লা রোড এবং পূর্ব দিকে গেছে সিলেট রোড।

যুদ্ধের সময় সরাইল ছিল একটি থানা এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছিল মহকুমা ।
আমাদের বাড়ি সরাইল এর উচালিয়া পাড়া নামক গ্রামে। শেরশাহ এর আমল থেকেই আমাদের বাড়ির খুব নাম ডাক চলছিল। যে কারণে ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেল স্টেশন এ নেমে রিক্সাওয়ালাদের যদি বলা হতো সরাইল বড় বাড়ি যাব তাহলেই ওরা চিনতে পারতো এবং পৌঁছায়ে দিতো। গ্রামের নামটা না বললেও চলতো। আট মাইলের এই পথটা ছিল বেশ সমস্যা সংকুল এবং দুর্গম। রাস্তাটার বেশীর ভাগ অংশ ছিল কাঁচা। মাঝে মাঝে ইট বিছানো এবং খাদে গর্তে ভরা। ছোট ছোট বেবী টেক্সি এবং রিক্সায় যেতেই ঝাঁকুনিতে শরীর ব্যথা করতো। অথচ সেই রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন গাঢ় সবুজ রঙের যুদ্ধের সরঞ্জাম বাহী বিভিন্ন ধরনের গাড়ী লাইন ধরে যতো। আমরা বাড়ীর সামনে দাঁড়িয়ে সেসব দেখতাম। যখন গাড়ীর সংখ্যা বেশি থাকতো এবং মাঝে মাঝে কামান যেতো, তখন আমাদের খুব অস্বস্তিকর লাগতো। ভয়ঙ্কর লাগতো এই কারণে যে, বেশী গাড়ী যাবার সাথে বেশী বোমা বর্ষণের আওয়াজ পাওয়া যেতো এবং উর্ধ আকাশে আগুনের স্ফুলিঙ্গ দেখা যেতো বেশী। আব্বা, কুতুব কাক্কু, আলমগীর মামা এবং আমাদের সকল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খুব কষ্ট হতো। ইচ্ছা করতো চিৎকার করে কাঁদি।

অন্যান্য দিনের তুলনায় দশ, এগারো ডিসেম্বরে সিলেট রোডে গাড়ীর সংখ্যা কম ছিল বলে মনে পড়ে। বিভিন্ন মাধ্যমে আগরতলা থেকে খবর পাওয়া যাচ্ছিল যে, মুক্তিযোদ্ধারা পাক সেনাদের হারিয়ে দিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল দখল করে ফেলেছে। তারপরও আতঙ্ক বিরাজ করছিল সকলের মনে। আমাদের মতো শহরে বাস করা অনেক পরিবার এসেছিল পঁচিশে মার্চের পরপর আত্মরক্ষার জন্য। বাড়ী ভর্তি অনেক মানুষ থাকলেও স্বরগোল কিংবা কোলাহল খুবই কম। সবাই যেন শ্বাস প্রশ্বাসের ক্ষেত্রেও সাবধানতা অবলম্বন করছে যাতে শব্দ না হয়।

বাড়ীতে আমার আম্মা ছিলেন সবচেয়ে বেশি অসহায়। আম্মার কাছে পাক হানাদার বাহিনীর বর্বরতার আতঙ্কের চেয়েও যেন বেশি দুঃখের আর অপমানের ছিল অভিযোগের এবং অপবাদের বিষয়টির। অভিযোগটি ছিল আব্বা মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছেন কারণে হানাদারদের দল অবশ্যই বাড়ী আক্রমণ করবে, আগুন ধরিয়ে দেবে, হত্যাযজ্ঞ ও তাণ্ডব চালাবে সর্বত্র। এবং সব কিছুর জন্যই দায়ী আব্বা। লজ্জা, অপবাদ, অপমান, অভাব, আতঙ্ক এসবের মধ্যেই ডুবে ছিল আম্মার জীবন। তারপরও অপেক্ষা ছিল স্বাধীনতার, সকল মুক্তিযোদ্ধাদের দেশে ফিরে আসবার, বঙ্গবন্ধুর মুক্তির এবং স্বপ্নের সোনার বাংলায় প্রাণ ভরে নিশ্বাস নেবার!!!


নাসরিন নাহীদ
১১ ডিসেম্বর ২০১৯

Previous
Previous

অনামিকার ভাবনা - সাঁইত্রিশ (37)

Next
Next

আমার বঙ্গবন্ধু পর্ব দুই (2)