অনামিকার ভাবনা - সাঁইত্রিশ (37)

আগরতলা পর্ব এক

১৩/০১/২০২০ তারিখে রওয়ানা হয়েছি খুব ভোরে। অর্থাৎ বাসা থেকে বেরিয়ে পড়েছি ভোর ছ'টার সময়। ঘন কুয়াশায় আচ্ছাদিত ঢাকা শহরটি। জনবহুল ঢাকা যেন শীতের কাঁথা মুড়ি দিয়ে শীতের আমেজে একটু উম পাবার আলসেমীতে ব্যস্ত। তাপমাত্রা ৯/১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলেও সজোরে বয়ে যাওয়া শীতের হাওয়ার জন্য তাপমাত্রার উপলব্ধি অনেকটাই প্রকট অনুভূত হচ্ছে। রাস্তা প্রায় জনশূন্য থাকবার কারণে মিনিট কুড়ি সময় খরচা হলো মোহাম্দপুর থেকে কমলাপুর রেল স্টেশনে পৌঁছাতে। দু'হাজার উনিশ এর জানুয়ারী থেকে আজ দু'হাজার কুড়ির জানুয়ারী পর্যন্ত অনেক পজিটিভ পরিবর্তনের কাণ্ডারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কার্যক্রমে মনটা বেশ খুশিতে এবং কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠলো। ভালো লাগলো দেশ, ভালো লাগছে অনেকিছু।

আমার সফর সঙ্গী হয়েছে আমার বন্ধু ও গৃহকর্তা তপু। ছেলে আরাফ টিকিট বুকিং ও বিভিন্ন দেশের হোটেল বুকিং থেকে শুরু করে যাবতীয় information এর কাজ করেছে। ছোট মেয়ে আদৃতা ভিয়েনা থেকে কেনা কাটা থেকে শুরু করে সব ধরণের গোছগাছ সেরে দিয়েছে। পথের খাবার গুলো পর্যন্ত যত্ন করে ভাগাভাগি করে দিতে ভূলে যায়নি আমাদের বড় মেয়ে আসত্রা। আসত্রা সারারাত ঘুমায়নি, সময় মতো আমাদের বের হবার বিষয়টি নিশ্চিত রাখবার জন্য। আমাদের বিদায়ের পর আসত্রা ঘুমাতে যাবার কথা জানালো।

বাংলাদেশ রেলওয়ে আন্তঃনগর সার্ভিস এর মহানগর প্রভাতী ৭০৪ নম্বর ট্রেনে টিকিট পেলাম ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের। কিন্তু আমাদের গন্তব্য আখাউড়া স্টেশন। স্নিগ্ধা শ্রেণীর চ আসনের টেবিলসহ বিপরীতমুখী দু'টি সীট। তাপানুকূল বগিতে চরলাম আমরা। সকালের নাশতা এলো চিকেন ফ্রাই, বার্গার, সেন্ডোয়িচ এবং কফি। খাবার পরিবেশনকারী একজন যুবক। ভূল করে দ্বিতীয় বার payment এর জন্য এলো। তপু paid amount এর কথা এবং তার ফেরৎ দেয়া amount এর কথা বলার সাথে সাথেই তার মনে পড়ে গেল। খুব লজ্জিত হয়েই ক্ষমা চেয়ে নিল আমাদের কাছে এবং আমরাও মন্জুরোক্তি বিনয়ের সাথে প্রকাশ করলাম।

কিছুক্ষণ পরেই যুবকটি আবার এলো। লজ্জা ভাঙ্গাবার উদ্দেশ্যেই কিছু কথা হলো। আমরা আখাউড়া স্টেশনে নেমে যাব শুনেই রেলের টিকিট দু'টি চেয়ে ফললো। আমি কিছু না বললেও হ্যাঁ বোধক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইলাম। তপু না বোধক মাথা নাড়লো।

আমরা যে বগিটিতে বসেছি সেটিতে মাত্র ক'জন যাত্রী। পঁচাত্তর ভাগ সীট যাত্রীশূন্য।
নিশ্চয়ই মানুষের আয়ের সাথে ভাড়ার সামঞ্জস্যতার অভাবের মূল কারণ এটি। আমাদের সামনে একটি মাঝারি সাইজের টেবিল। মুখোমুখি আরো দু'টি সীট। অনেকক্ষণ ধরেই সীট দু'টি ফাঁকা। ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেল স্টেশন থেকে বেশ কিছু যাত্রী উঠলো। দুজন যাত্রী আমাদের বিপরীতের সীট দু'টিতে বসলেন। একজনের বয়স ষাট উর্ধ, সাদা দাড়ি এবং ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি পায়জামা পরিহিত। অন্য জনের বয়স চল্লিশের কোঠায় সাধারণ পোশাক অর্থাৎ শার্ট পেন্ট পরিহিত। তাদের সাথে আমাদের গল্প আলাপ জমে গেল আড্ডা পর্যায়ে। পুলিশে কর্মরত আছেন বলেই পরিচয় দিলেন দু'জনে। বয়োবৃদ্ধ সুফি স্টাইলের ভদ্রলোক বললেন একচল্লিশ বছর ছয় মাস ধরে সরকারের হয়ে জনগণের সেবা করে যাচ্ছি। আমি জানতে চাইলাম তার বাড়ি সম্পর্কে। তিনি বললেন বাড়ী কসবায়। আমি বললাম, আপনি তো আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাহেবের এলাকার লোক। তিনি ছোট্ট করে উত্তর করলেন "হ"(ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভাষায়)। আমাদের ঢাকা টু চট্টগ্রামের টিকিট কিন্তু আখাউড়া নেমে যাব শুনেই বয়স্ক সুফি স্টাইলের ভদ্রলোক টিকিট দু'টি চেয়ে ফেললেন। আমরা দু'জন চুপ করে রইলাম। নেমে যাবার ক্ষণে ভদ্রলোক আবার ও টিকিট চাইলেন। তপু বললো আপনাকে টিকিট দেয়া যায় না। আপনি ঠিক দামে কিংবা চড়া দামে টিকিট বিক্রি করে বাড়তি অর্থাৎ কালো রোজগার করবেন। কিন্তু এমন করলে সরকার চলবে কিভাবে? আমি আপনাকে টিকিট দেবো না বলে তপু নেমে পড়লো। আমি ও নামলাম পিছু পিছু। আমরা দেখলাম, দরজার কাছেই প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা সাদা পোশাকে রেলওয়ের কর্মরত Buffet boy. টিকিট চাইলো। তপু বললো আন্তরিকতার সাথে সৎভাবে কাজ করবেন। দেশের ভালো হলে আপনারও ভালো হবে। শুধু সরকার এর দিকে তাকিয়ে থাকলে দেশের ভালো হবে কিভাবে ???


নাসরিন নাহীদ
১৪ জানুয়ারী ২০২০

Previous
Previous

অনামিকার ভাবনা - আটত্রিশ (38)

Next
Next

আমার বঙ্গবন্ধু - পর্ব তিন (3)