অনামিকার ভাবনা - আটত্রিশ (38)

আগরতলা
পর্ব দুই

তের জানুয়ারী সকাল দশটা তের মিনিট এ ট্রেন থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করলাম তপুকে অনুসরণ করে। মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে ট্রেনে বসে থাকা আড়াই ঘণ্টা সময়ের ভিতরে নজরে পড়া নানান বিষয়। আমাদের উদ্দেশ্য একটা অটো রিকশা নিয়ে আগরতলা বর্ডার এ যাওয়া। তপু রিকশা দেখতে দেখতে আমার কাছ থেকে বেশ খানিকটা পথ এগিয়ে গেছে। আমি হাঁটছি ধীরে ধীরে আর তপু হাঁটছে দ্রুত। আখাউড়ায় আমার অনেক হৃদয়স্পর্শী ভালোলাগার স্মৃতি রয়েছে। ১৯৬৮ সালে আমি আখাউড়া রেলওয়ে স্কুলের ছাত্রী ছিলাম। রেলওয়ে স্কুলের কাছাকাছি ছিল আমাদের বাসা। সরকারি বাসা, লাল রঙের ধাপ সিঁড়ির বাঁধাই করা পুকুর ঘাটসমেত বাংলো বাড়ী বললেই যথার্থ মূল্যায়ন হবে। আব্বা তখন ইপিআর এর সিকিউরিটি ইনচার্জ এর দায়িত্বে ছিলেন। আম্মার আপন চাচাতো বোন জুনার খালাম্মার বিয়ে হয়েছে খাদেম বাড়ীতে। খালাতো বোন সিরাফ আপা এবং শরীফ এর সাথে একাত্ম হয়ে থাকবার ভালো লাগার অনুভূতি বিশেষভাবে আন্দোলিত করছে মনটাকে।

এরই মাঝে অটোরিকশা ভাড়া করা হয়ে গেছে। আমি একটু দ্রুত হেঁটে অটোরিকশায় চড়তে চড়তে চালকের নামটা জেনে নিলাম। সাধারণত আমি অপরিচিত কাউকে ব্যক্তিগত প্রশ্ন করি না।
কিন্তু ছিপছিপে গড়নের, উজ্জল গাত্রবর্ণের, অভিজাত চেহারার, ষোল-সতেরো বছর বয়সী শাহীন নামের এই ছেলেটিকে দেখে অন্য ধরনের মনে হলো বলেই প্রশ্নগুলো মন থেকে আপনাআপনি উঠে এসেছে। যে বয়সে স্কুল কলেজের করিডোরে চলা ফেরা করার কথা সে বয়সে ছেলেটি যন্ত্রচালিত রিক্সার স্টিয়ারিং নিয়ন্ত্রণে ব্যস্ত। আমি ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলাম ভাতশালা স্টেশন এবং চিনাইর বাজার চিনে কিনা? আমার প্রশ্নের সাথে সাথেই অধীর আগ্রহে তপু বললো আমাকে ওখানে নিয়ে যেতেই হবে। কারণ তপু বহুবার আম্মা এবং মেঝখালাম্মার কাছে আবদার করেছিল নানার আদিবাস ভাতশালায় নিয়ে যাবার জন্য। কিন্তু সময়ের অভাবেই সেটি আর হয়ে উঠেনি। আমার নানা কলকাতায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করে বৃটিশ রেলওয়েতে চাকুরি নিয়েছিলেন। তৎকালীন সময়ে খুব কাছাকাছি দূরত্বে পাঘাচং স্টেশন থাকা সত্বেও নানা মরহুম মোহম্মদ সিরাজুল হক ভূঁইয়া সাহেবের সৌজন্যেই স্টেশনটি স্থাপিত হয়। আনুমানিক পনেরো ষোল মিনিট এর মধ্যেই আমরা পৌছে গেলাম ভাতশালা ট্রেন স্টেশনে। অনেক অনেক স্মৃতি বিজড়িত এই স্টেশন। ছোট বেলায় আম্মা আব্বার সাথে বহুবার গেলেও বড় হয়ে পারভীন আপার সাথে ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেল স্টেশন থেকে ভাতশালা স্টেশন পর্যন্ত যাওয়ার অনেক রোমাঞ্চকর স্মৃতি আছে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম ভূঁইয়া বাড়ী অর্থাৎ নানার বাড়ীতে। স্টেশন থেকে রাস্তাটা সরাসরি ভূঁইয়া বাড়ীর পুকুর ঘাট এবং মসজিদের সাথে গিয়ে মিলেছে। আমাদেরকে দেখে এক এক করে কয়েকজন লোক বেরিয়ে এলো। গতবছর অর্থাৎ ২০১৯ এর জানুয়ারিতেও একই ঘটনা ঘটেছিল যখন আমার ছোট বোন নাজনীন ওর গাড়ী নিয়ে সরাইল যাওয়ার পথে আমাকে নিয়ে নানার বাড়ীতে গিয়েছিল। প্রথমেই নানার নাম বলার সাথে উপস্থিত সকলেরই জিজ্ঞাসা ছিল আপনার আম্মা র নাম কি? একই প্রশ্ন আমাকেও করা হয়েছে। বললাম "মেরী" আম্মার নামটা। আবুবকর নামে একজন ভদ্রলোক বললেন দতাইসার প্রাইমারি স্কুলে তিনি আমার সাথে পড়েছেন। পুরাতন অনেক স্মৃতি কথা তিনি বললেন, শুনে খুব ভালো লেগেছে। শাহ্ আলম বাড়ী ঘর ঘুরে ঘুরে দেখালো। বেশীর ভাগ বাড়ী জনশূন্য। দু এক জনের সাথে দেখা তবে সকলের মধ্যেই চলনে বলনে অনেক আন্তরিকতা।

পুরাতন মসজিদ নতুন করে সংস্কার করার জন্য তাসদিক ভাইজান এর অবদানের কথা কথা জোর দিয়ে বললেন সবাই এবং প্রশংসা ও করলেন। কিছু ছবি তুলে আগরতলা বর্ডার এর দিকে যাত্রা শুরু করলাম। ভাতশালা স্টেশন পাড় হয়ে খুব কাছাকাছি বাসুদেব। আমরা থামলাম। নেমে কিছু ছবি তুললাম। তপু বললো আলমগীর মামা, জাহাঙ্গীর মামা, জালাল মামাদের বাড়ী। আমি বুঝতে পারলাম লেখাটা এখনই শেষ করা প্রয়োজন। কারণ বাসুদেব নিয়ে লিখতে গেলে এতো স্বল্প পরিসরে কিছুই প্রকাশ করা যাবে না। বাসুদেবের আমার সকল প্রিয় মানুষদের মনের মধ্যে ধারণ করে চললাম আগরতলা বর্ডার এর দিকে। বা'দিকে রইলো অনেক স্মৃতি বিজড়িত ভাতশালা আর ডানে রেখে আসতে হলো বাসুদেব।

নাসরিন নাহীদ
পনর জানুয়ারী ২০২০

Previous
Previous

অনামিকার ভাবনা - ঊনচল্লিশ (39)

Next
Next

অনামিকার ভাবনা - সাঁইত্রিশ (37)