অনামিকার ভাবনা - তেত্রিশ (33)

শাহ্ মোহম্মদ ফরহাদ
(পর্ব ছয়)

আমার তেত্রিশ বছরের ভিয়েনার জীবনে কখনো এমন লাগাতার মেঘাচ্ছন্নতা আর বৃষ্টিপাতের ঘটনা দেখিনি। বলা যায় বৃষ্টিপাতের এমন অনিয়মের ঘটনা প্রকৃতই ঘটেনি। ক্রমাগত বৃষ্টি ঝরার সাথে ঝড়ো হাওয়ার বিষয়টি ও উল্লেখ করতে হয়। তাপমাত্রার রেকর্ড ও স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে নীচে। অর্থাৎ এপ্রিল ও মে মাসে তাপমাত্রা যা থাকবার কথা তারচেয়ে অনেক কম। এপ্রিল মাসে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা এক ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছিল। বৃষ্টিপাতের এবং হাওয়ার দাপটে অনুভূত হয়েছে কয়েক ডিগ্রি সেলসিয়াস কম। মে মাসেও একই অবস্থা। তবে রোজার মাসে এতো বড়ো এক একটি দিনের রোজায় আবহাওয়ার এমন নিম্নাবস্থানে থেকে রোজাদারদের অনুকূলে অবস্থান নেবার কারণে রোজাদারগন বেশ খুশি। কেন এতদিন ধরে ঝরছে বৃষ্টি এ নিয়ে কারো মনে কোন প্রশ্ন আছে কিনা জানিনা তবে আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের কিছু ভাবনা আছে। এ বিষয়টিতে আলোকপাত করব লেখাটির শেষাংশে।

মে মাসের দশ তারিখ শুক্রবার পঞ্চম রোজার দিনে সকাল ন'টা পঁয়তাল্লিশ মিনিট এ একটি মুঠোফোন সংবাদ টর্নেডোর মত এসে এক ঝাপটায় আমাকে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলল। ফোনের ওপাড় থেকে আমার husband তপন বলছিল " ফরহাদ ভাই মারা গেছেন। তাড়াতাড়ি নীচে নেমে আস। আমি নীচে।"

আমি ইনশাল্লাহ্ পড়ে জোরে জোরে আল্লাহ্ আল্লাহ্ বলে চিৎকার করছি। আমার ছেলে আরাফ আমার কাছে থেকেও কিছুই বুঝতে পারছিল না। ওর প্রশ্ন ছিল কি হয়েছে? আমি বললাম ফরহাদ ভাই নেই। আরাফ একদৌড়ে আসত্রা ও আদৃতার (আমার দুই মেয়ে) কাছে গিয়ে বলল "ফরহাদ মামা মারা গেছেন।" একই সময়ে ফোন বাজতে থাকল , আরাফ ফোন ধরে আমাকে দিল। ফোন কলটি ছিল আমার ছোট বোন মাসুমের। মাসুম লন্ডন থেকে সপ্তাহে কয়েক বার ফোনে আমাদের খোঁজ খবর নিয়ে থাকে। আমি মাসুমকে ফরহাদ ভাই এর মৃত্যু সংবাদ দিয়ে বললাম তাড়াতাড়ি মাহমুদকে জানাতে, নিয়াজকে জানাতে এবং ফরহাদ ভাই এর ঘনিষ্ঠজন যারা ভিয়েনা থেকে লন্ডন গিয়েছে তাদের জানাতে।

আমি এত দ্রুত তৈরী হয়ে নীচে নামতে থাকলাম যে ঘড়ির সেকেন্ডের কাঁটাও যেন আমার সাথে পেরে উঠছিল না। আমার সাথে আমার ছেলে আরাফ যাচ্ছিল। মেয়ে দুটিকে সাথে নিয়ে যাওয়ার চিন্তা করলাম না সময়ের কথা ভেবেই। নীচে অপেক্ষেয়মান গাড়ীতে চেপে পৌছে গেলাম হাসপাতালে। আমার husband তপন জোরে জোরে কাঁদছিল। হাসপাতালের বিছানায় নিরব নিথর হয়ে শুয়ে আছেন ফরহাদ ভাই। বিছানার ডান পাশে তিথি দাড়িয়ে আছে। বা দিকে দাঁড়ানো লীমান ভাবী একটা হাত ফরহাদ ভাই এর কপালের উপরে রাখা। ভাবীর দিকে একটি চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বসাতে চাইলাম, একটু পানি খাওয়াতে চাইলাম, কিন্তু হলো না। প্রশ্নকারীদেরকেও বাঁধা দিলাম প্রশ্ন করার বিষয়ে। একে একে লোকসংখ্যা বেড়েই চলেছে হাসপাতাল কক্ষে। প্রশ্ন হচ্ছে, উত্তর হচ্ছে, হচ্ছে কান্নাকাটিও।

খবর এলো ১২ টার সময় লাশ নিয়ে যাওয়া হবে হিমাগারে। প্রাণহীন নিথর ফরহাদ ভাই এর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখছি। শরীর ঢাকা হালকা লেপ দিয়ে। আমি লেপের উপর দিয়েই ভাই এর পা দুটি ধরলাম। চোখের পানি মুছে শেষ করতে পারছি না। জীবিতাবস্থায় কখনো ছুঁতে পারিনি ভাই এর চরণ। যার আপাদমস্তক নিয়োজিত ছিল মানুষের দুঃখ দুর্দশা লাঘবের চেষ্টায় তিনি কাউকে কিছু না বলেই বিদায় নিয়ে নিলেন। যিনি মানুষের দুঃখ দুর্দশা লাঘবের চেষ্টায় মেঘ হয়ে ছায়া দিয়ে রাখতেন মানুষকে, বৃষ্টির মত ঝরে সরিয়ে দিতেন ঝামেলা এবং দিতেন শান্তির শীতল পরশ। তিনি (ফরহাদ ভাই) আর ফিরে আসবেন না কোন দিন, ভাববেন না কারো সমস্যা নিয়ে। কাঁদছে মানুষ, কাঁদছে প্রকৃতি, কান্না হয়েই ঝরছে বৃষ্টি অবিরাম।


"চলবে"

Previous
Previous

অনামিকার ভাবনা - চৌত্রিশ (34)

Next
Next

অনামিকার ভাবনা - বত্রিশ (32)