অনামিকার ভাবনা - একত্রিশ (31)
শাহ্ মোহম্মদ ফরহাদ
(পর্ব চার)
"মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য" এ উক্তি দুটি আমাদের এতো বেশী পরিচিত যে উক্তি দুটির অর্থ আমরা জানি বলে দাবি রাখলেও এর নিগূঢ় অর্থ কি আমরা সত্যিই জানি? আমি আমার করণীয় কাজের দশভাগের একভাগ করেই মনে করি অনেক করেছি আর পারছি না। তাকিয়ে দেখি তাদের দিকে যারা নিজের সংসার সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে সাচ্ছন্দে করছে জীবন যাপন। বার বারই আমি ভুলে যাই মানুষের জন্য ভাবতে কিংবা তাদের সাথে সাথে থাকতে অথবা পাশে দাঁড়াতে। আমরা চাইলেও হতে পারিনা দুঃখী এবং সমস্যা সংকুল মানুষের নিরাপদ আশ্রয়স্থল।
মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে আমাদের রয়েছে নানান ধরনের সংকট। আমরা বুঝতে পারি সহযোগিতা করা একান্ত প্রয়োজন কিন্তু কিভাবে করবো বুঝতে পারিনা। অথবা বুঝতে পারলেও করতে পারিনা বা করার সামর্থ্য রাখিনা। অন্যদিকে করতে পারলেও তার ইতিবাচক ফলাফলটি ধরে এনে সমস্যা থেকে বের করে নিয়ে আসতে পারিনা সেই সমস্যাগ্রস্থ মানুষটিকে। অথচ আমাদের ফরহাদ ভাই ছিলেন এর ব্যতিক্রম। আমার মতে বহুমুখী জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার অধিকারী ফরহাদ ভাই নিজেই ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান। যে কারণে তিনি এককভাবেই সমাধান করে ফেলতে পারতেন বহুমুখী সমস্যার। এছাড়া ও একজন mentor হিসাবে তিনি পাশে থাকতেন সকলের।
জীবনের বিভিন্ন বাঁকে আমি পেয়েছি ফরহাদ ভাইকে। কখনো কাউকে কোনো কাজের জন্য অনুরোধ করতে হয়নি তাঁর কাছে, করতে হয়নি অনুনয় বিনয়। এদেশের ডাক্তাররা যেমন রোগী পাবার পর নানান ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষা করে রোগ নির্ণয় করে যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব রোগীকে সুস্থ করে তোলে ফরহাদ ভাই ও ছিলেন ঠিক তেমনি। সমস্যা পেলেই হতো সমাধান এর দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে নিয়ে নিতেন তিনি। তবে ডাক্তার এবং ফরহাদ ভাই এর মধ্যে পার্থক্য ছিল এই যে একটা হচ্ছে profession যার সাথে রয়েছে অর্থযোগ। অন্যটি হচ্ছে সহযোগিতা যার কোন মূল্য নির্ধারণ অসম্ভব। কারো সমস্যা দেখলে কিংবা বুঝতে পারলেই ফরহাদ ভাই রীতিমতো ঝাঁপিয়ে পড়তেন সমস্যার প্রতিকূলে। দুঃখ কষ্ট দূর করা এবং সমস্যার সমাধান করাকে ব্রত হিসাবে নিয়েছিলেন এই মহামানব।
জানাযার নামাজের শেষে বায়তুল মোকাররম মসজিদে মরহুম শাহ্ মোহম্মদ ফরহাদ ভাই এর জন্য দোয়া মাহফিল এর আয়োজন করা হয়। কোরআন ও হাদিস শরিফের আলোকে বয়ান করা হয়। ফরহাদ ভাই এর সান্নিধ্যে আসা অনেকে এবং বিভিন্ন দেশ থেকে আসা আত্মীয় স্বজনদের অনেকেই নিজ নিজ অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন। অনেকেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন, হারিয়ে ফেলেন প্রকাশের ক্ষমতা। লন্ডন থেকে এসেছিলেন তাহের ভাই। তাহের ভাই ১৯৮৩ সালে ভিয়েনায় এসেছিলেন ফরহাদ ভাই এর Sponsor এ। ভিয়েনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবার আগে তাহের ভাই ফরহাদ ভাই এর স্ত্রী জান্নাতুল ফরহাদ লীমান ও শিশু কন্যা ফারজানা ফরহাদ তিথির সাথে দেখা করতে যান। লীমান ভাবী তাহের ভাইকে বলেছিলেন যে "আপনি ফরহাদকে বলবেন তাড়াতাড়ি যাতে আমাদের ভিয়েনায় নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করে।" একথা বলতে বলতে তাহের ভাই অঝোরে কাঁদতে থাকেন। তাহের ভাই আরো বলেন "আমি ফরহাদ ভাই এর আত্মীয় পরিজনদের কেউ ছিলাম না এমনকি কোন ধরনের পরিচয়ও ছিলনা তাঁর সাথে। আমার প্রয়োজনের কথা চিন্তা করে আমাকে sponsor করলেন নিজের পরিবারের কথা বাদ দিয়ে। তাঁর মত এতো বড়ো মনের মানুষ আমি কোথাও দেখি নাই এমন মানুষ কোথাও আছে কিনা জানিনা।" প্রশ্ন উঠতে পারে যে এমন একজন মানুষ যিনি স্ত্রী সন্তানের প্রয়োজনের চেয়ে অন্যের প্রয়োজনের কথা বেশি ভাবেন তাঁকে কিভাবে আমরা মহান ব্যক্তি হিসেবে দেখছি? একজন মহান ব্যক্তিই পারেন নিজের সুখ সাচ্ছন্দের চিন্তা বাদ দিয়ে অন্যের পাশে তার সমস্যা সমাধানের জন্য দাঁড়াতে। স্ত্রী সন্তানকে তিনি কখনো উপেক্ষা করেনি কিংবা রাখেননি ইচ্ছাকৃত দূরে। নিজের প্রাণের মানুষের নিজের একান্ত আপন জনের সুখ- সাচ্ছন্দের চিন্তা বাদ দিয়ে যিনি সারাটা জীবন উৎসর্গ করে করে গেছেন অন্যের জন্যে এমন পরোপকারী মানুষটি ভূষিত হবেন নানান বিশেষণে এটাই তো পৃথিবীর স্বাভাবিক নিয়ম।
ফরহাদ ভাইকে হারানোর মতো এতো বড়ো ক্ষতি সত্যি অপূরণীয়। নীরবে নিভৃতে কত মানুষের উপকার যে ফরহাদ ভাই করে গেছেন তা শুধু আল্লাহ্ পাকই ভাল জানেন। আজ আল্লাহ্ তায়ালার কাছে আমাদের সকলেরই ফরিয়াদ আল্লাহ্ যেন মরহুম ফরহাদ ভাইকে উত্তম প্রতিদান দান করেন, তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করেন, তাঁর পরিবারকে ধৈর্য্য ধারণ এর ক্ষমতা দান করেন, এবং সমস্যা সংকুল সকল মানুষের সব ধরনের সমস্যার সমাধান করে দেন।
"চলবে"