অনামিকার ভাবনা - উনত্রিশ (28)

মরহুম শাহ্ মোহম্মদ ফরহাদ
(পর্ব এক)

পৃথিবীতে আল্লাহ্ পাক তাঁর পছন্দের এক একজন বান্দাকে প্রেরণ করেছেন নির্ধারিত কিছু দায়িত্ব দিয়ে। আল্লাহ্ তায়ালা নিঃসন্দেহে এসব কঠিন দায়িত্ব পালনের ক্ষমতার অধিকারী করেও পাঠান তাঁদেরকে। সাথে সাথে তাঁদেরকে মর্যাদাপূর্ণও করে দেন সন্দেহাতীত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, দূরদর্শীতা, ধৈর্য, সহনশীলতা, সত্যবাদিতা, সততাসহ নানাবিধ গুরুত্বপূর্ণ গুনাগুন দিয়ে। এক জীবন সময়কাল এর মধ্যে মানুষের সুখ- দুঃখ ভেবেই কেটে যায় এ সকল মহান ব্যক্তিবর্গের জীবন। জীবন ধারার অলিগলিতে খুব কমই থাকে নিজের এবং স্ত্রী সন্তানের জন্য ভাববার সময়। বলতে হবে যে তাদের আত্মিক সম্পর্কের জোরেই টিকে থাকে পারিবারিক সম্পর্ক। শাহ্ মোহম্মদ ফরহাদ হচ্ছেন সেরকম একজন বিশেষ মানব যার আকস্মিক প্রয়াণে ব্যথিত এবং শূন্যতায় দেশ-বিদেশের অগণিত মানুষ। যার আত্মার মাগফেরাত কামনা করা ছাড়া আজ আর আমাদের কিছুই করার নেই।

শাহ্ একটি ফার্সি শব্দ। এর অর্থ বাদশাহ বা রাজা। পার্সিক ধর্মগ্রন্থ আবেস্তায় শাহ্ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে রাজশক্তি হিসেবে। আমাদের ভারতবর্ষের সুলতানি আমলের এবং মোঘল আমলের শাসকদের সাথে শাহ্ পদটি পদবী হিসেবেই যোগ করা হতো। এছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের পীর-দরবেশ শাহ্ পদবীতে নিজেদের ভূষিত করেছিলেন এবং আজ অবধি করে আসছেন। কিন্তু আমাদের শাহ্ মোহম্মদ ফরহাদ ভাই সেই অর্থে অথবা সে ধরনের শাহ্ না হলেও তিনি ছিলেন আমাদের সকলের কাছেই বাদশার বাদশাহ্, রাজা- রাজাধিরাজ। প্রকৃত শাহ্! প্রকৃত বাদশাহ্! মুকুট বিহীন বাদশাহ্! যিনি বিপদগ্রস্থ এবং হতাশাগ্রস্থ মানুষের অন্তরের বাদশাহ্ ছিলেন।

অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় বসবাস করতেন ফরহাদ ভাই। উচ্চবিত্ত প্রথম শ্রেণীর শিক্ষিত পরিবারের সদস্যদের একজন ছিলেন ফরহাদ ভাই। তিনি ১৯৮০ সালে যখন বাংলাদেশ থেকে ভিয়েনায় এসেছিলেন। এমন উচ্চবিত্ত পরিবারে বড় হয়ে অন্যের দুঃখ দুর্দশা লাঘবের চেষ্টায় নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার মানসিকতা ধারণ করার বিষয়টি সত্যিই বিরল। ঐ সময়ে বাংলাদেশের সর্বত্রই বিরাজমান ছিল ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের নানান রকমের সংকটের অসহনীয় অবস্থা। দেশ ছেড়ে যখন কেউ অস্ট্রিয়ায় আসতো তখন সকলের ক্ষেত্রেই যোগ হতো উন্নত দেশের নিয়ম কানুন ও আইনি জটিলতার সমস্যা। এছাড়াও অস্ট্রিয়ার ভাষা ডয়েচ হবার কারণে এদেশে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতেও পোহাতে হতো বহুমুখী সমস্যা। তখন বাংলাদেশীদের সংখ্যা এত কম ছিল যে সহযোগিতা পাওয়া তো দূরের কথা একজন বাঙালীর দর্শন পাওয়া ছিল অমাবস্যার চাঁদের দর্শন পাওয়ার মতো। শাহ্ মোহম্মদ ফরহাদ কখনো ভূলে যাননি নিজের দেশের কথা, দেশের দুর্দশাগ্রস্থ মানুষের কথা। নিজের সাধ্যের মধ্যে যতটুকু করা সম্ভব ছিল ততটুকু করার পর তিনি দ্বারস্থ হতেন ঐ কাজে সমর্থ অন্য কোন হৃদয়বান ব্যক্তির। সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত তিনি হাল না ছেড়ে চালিয়ে যেতেন প্রচেষ্টা। যেভাবেই হউক না কেন মন-প্রাণ দিয়ে তিনি করে গেছেন পরোপকার। কাউকেই তিনি পর ভাবতেন না। আর তাঁর কার্যক্রম দেখে মনে হতো পরোপকার কথাটা তাঁর ক্ষেত্রে ঠিক মানানসই নয়। কারণ প্রয়োজন বোধে তিনি নিজের সমস্যা তোয়াক্কা না করে উপকার করে যেতেন নির্বিকার চিত্তে। তাঁর কাছে পরোপকার বলতে কিছুই ছিল না সবই ছিল আপন বা নিজ উপকার।

শাহ্ মোহম্মদ ফরহাদ ছিলেন অস্ট্রিয়ায় অবস্থানরত সকল বাংলাদেশিদের বাদশাহ্ । আইনের আওতায় থেকে তিনি প্রতিষ্ঠিত করেছেন বাংলাদেশিদের ভিয়েনায়, অস্ট্রিয়ার অন্য কোন শহরে কিংবা অন্য কোনো দেশে। অন্তরে শাহ্ মোহম্মদ ফরহাদ নামের শাহ্ বা বাদশাহ্ কে প্রাণে ধারণ করে অনেক বাঙালি ছড়িয়ে ছিটিয়ে অবস্থান করছেন ইউরোপের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন প্রান্তরে।

আজ আমরা শূন্য হৃদয় এবং হতবাক। দোয়া করা ছাড়া আজ আমাদের কিছুই করার নেই। সশ্রদ্ধ ভালোবাসা মরহুম শাহ্ মোহম্মদ ফরহাদ ভাই এর প্রতি। আল্লাহ্ তায়ালার কাছে আমাদের ফরিয়াদ তাঁর জান্নাত নসীব এর। আমীন!

"চলবে"

Previous
Previous

অনামিকার ভাবনা - উনত্রিশ (29)

Next
Next

অনামিকার ভাবনা - সাতাশ (27)