অনামিকার ভাবনা - সাতাশ (27)
ফাল্গুনের প্রতীক্ষা
আমার মধ্যে একটা বসন্ত বিলাসি মন আছে। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের বসন্তকালের বসবাসই আমার মনে। ষড়ঋতুর চলমান প্রক্রিয়ায় বেড়ে উঠা জীবনে নানান ক্ষণে নানান আঙ্গিকে উপভোগ্য হয়েছিল এ ঋতুটি আমার কাছে।
প্রকৃতপক্ষে ঋতুচক্রের প্রতিফলন গ্রামীণ কৃষকদের মধ্যেই বেশি যা উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনার জন্যই হয়ে থাকে। অন্যান্য ঋতুর মধ্যে আয়োজন এবং প্রয়োজনের বিষয়টি তুলনামূলক ভাবে বেশি হলেও বসন্তকালে আরাম আয়েশ আর ভোগ বিলাসের সুযোগটা বেশী। কোকিল এর কুহুতানে ঋতুটির আগমনেও রয়েছে বিশেষ শৈল্পিক সৌন্দর্য। ফুলের শোভায়, পাখির কূজনে গ্রাম কিংবা শহর সর্বত্রই বসন্ত খুঁজে ফেরে বসন্ত বিলাসিদের। আর এমন আহ্বানে শহরের বসন্ত প্রেমিরা নানান আঙ্গিকে আমন্ত্রণ জানিয়ে ধন্যমনে করে নিজেদের ।
এ বছর জানুয়ারী মাসের দ্বিতীয়ার্ধে আমি আমার গ্রামের বাড়ি অর্থাৎ দাদার বাড়িতে গিয়েছিলাম। বেশ কয়েক দিন কাটিয়েছি অনেক আনন্দে, শান্তিতে, আদরে আর উপভোগের সর্বোচ্চ বিলাসিতায়। এই ভোগ বিলাসবহুল অবস্থান অনেকের সহযোগিতায় হলেও একটি নাম না বললেই নয় সে হচ্ছে পারভীন। পারভীন আমার বয়সে অনেক ছোট হলেও পারিবারিক পদমর্যাদায় অনেক বড়। এমন সুদক্ষ, সহজ সরল বাস্তববাদী মানুষের সাক্ষাৎ এ জীবনে কমই মিলেছে। পারভীন আমার শানু কাক্কুর সহধর্মিণী।
প্রতিদিন ফজরের আযান এর পরেই ঘরের বাইরে আশেপাশের ঝোপ ঝার থেকে ডাকতে শুরু করতো নানান গোত্রের পাখি। সব পাখির ডাকের মধ্যে একটা সুমধুর ভরাট স্বরের, হৃদয়ছোয়া অনেক স্মৃতিবিজড়িত একটা ধ্বনি ভেসে আসতো। টু-উ, টু-উ সুরে ডাকা এই পাখিটি আমাকে ঘুরিয়ে নিয়ে এসেছিল বহু দূর অতীত থেকে। কত বছর এ ডাকটা শুনিনি। এতো পরিচিত পাখির নামটাও আমি মনে করতে পারলাম না। পারভীনের কাছে পাখির নামটা জানতে চাইলাম। পারভীন বললো এইটা "কুটুম পাখি " বাড়িতে কুটুম আসলে এই পাখিগুলি ডাকতে শুরু করে।
মাঘ মাসের আরামের শীতের আমেজ নিয়ে ৩১ জানুয়ারী বিদায় নিলাম বাড়ি থেকে। বাড়িতে সবার কাছ থেকে বিদায় নিতে নিতে বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেল । অনেক দূর পর্যন্ত বিদায় জানাবার জন্য এগিয়ে এলো আত্মীয় স্বজনদের অনেকে। আমিও তাদের দিকে তাকিয়ে দেখছিলাম হৃদয়ছেড়া অশ্রু মুছতে মুছতে। বাড়ি থেকে ঢাকা পর্যন্ত আসার পথে আলো আঁধারে কুয়াশায় ঘেরা ফসলের ক্ষেত, গাছপালা, ফুলফল, নদীখাল, ফুরফুরে হাওয়া সব কিছুতেই আমি খুঁজে পেয়েছিলাম ফাল্গুনী আমেজ।
পাঁচ ফেব্রুয়ারি আমি ফিরে এসেছি আপন ঠিকানায়। মনটা পড়েছিল পিছনে।
খুব ইচ্ছে করছিল পহেলা ফাল্গুনের অনুষ্ঠান এ যাওয়া, বইমেলায় যাওয়া, একুশে ফেব্রুয়ারীতে শহীদ মিনারের আনুষ্ঠানিকতায় যাওয়া ইত্যাদি। তবে অনেকেই আমার কাছে বিভিন্ন ধরনের ফাল্গুনী শুভেচ্ছাবার্তা সম্বলিত ছবি কিংবা লগু পাঠিয়েছিল। মজার ব্যাপার হলো পহেলা ফাল্গুনের দিন সকালে পারভীন আমাকে একটা ছোট্ট VDO পাঠিয়েছিল, যে VDO টি দেখে গৃহকাতরতায় আকুল হয়েছিল আমার মন প্রাণ। কোকিলের কুহুতানে মনটা আমার নিজের অজান্তেই গাইতে শুরু করেছিল সেই পুরনো গানটি।
"কোকিল যখন হৃদয়টাকে
পাগল করে ডাকে
কেমন কেমন যেন লাগে ।।"