অনামিকার ভাবনা - ষোল (16)
শীতকালীন মেলা
শীতকালে অষ্ট্রিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে মেলা বসে চিরাচরিত নিয়মে এবং তা বেশ ঘটা করেই। বিশেষ করে বড়দিন উপলক্ষেই বসে মেলাগুলো। রাজধানী ভিয়েনার সবচেয়ে বড় মেলা বসে স্ট্যেফানস্ চার্চের সামনে। নভেম্বর মাসের সতের তারিখ থেকে নিয়ম মাফিকভাবে শুরু হয় এই মেলা এবং শেষ হয় পঁচিশে ডিসেম্বরে। মেলাটির নাম "Christkindlmarkt". ডয়েচ ভাষায় Markt শব্দটির অর্থ বাজার।
সরকারের নিয়ন্ত্রনাধীনে থাকে মেলার সার্বিক বিষয়। স্থানানুযায়ী বসানো যেতে পারে সাতশত দোকানের বেশী। দোকান বসানোর জায়গা এবং কাছেই আছে ছোট্ট একটি বরফে স্কেটিং করার মাঠ। কেউ স্কেটিং করতে চাইলে তাকে ঢোকার টিকিট কিনতে হবে এবং পোষাক ও জুতা ভাড়া করারও ব্যবস্থা আছে। ঘুরে ঘুরে দেখার সুবিধার জন্য আছে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও প্রশস্ত পথ এবং বসার জন্য আসনের ব্যবস্হা। এছাড়াও অস্থায়ী টয়লেটের ব্যবস্হাও রয়েছে জায়গায় জায়গায়। জনসাধারনের সুবিধার্থে প্রয়োজনীয় কোন ব্যবস্থারই ঘাটতি নেই সেখানে।
আমরা কর্মস্হল থেকে সব সহকর্মীরা মিলে মেলা দেখতে গিয়েছিলাম চব্বিশে নভেম্বরে। মেলার সম্পূর্ন আয়োজন এক সপ্তাহ আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। আমরা মোট একশত পয়ত্রিশটি দোকান দেখে ফিরে এসেছিলাম। এর মধ্যে খাবার এবং হস্তশিল্পের দোকানের সংখ্যাই বেশী ছিল। দোকান গুলো থাকে মালবাহী গাড়ীর মত কিন্তু একদিকে দরজা থাকে যা উপর ও নীচের দিকে ঠিক দোকানের মতই খোলা এবং বন্ধ করা যায়। ভিতরে মালপত্র থাকে সম্পূর্ণভাবে গুছানো। নির্ধারিত তারিখে শুধুমাত্র স্থানান্তর করা হয় স্থান এবং দোকানের নম্বর অনুযায়ী।
মেলায় কোন প্রবেশ খরচ নেই, নেই
কোন কোলাহল অার বিশৃঙ্খলা। দোকানে দোকানে আলাদাভাবে মিউজিক বাজানো হয়না। নিয়ন্ত্রনকারীর পক্ষ থেকে একটি জায়গা থেকেই মিউজিক বাজে। তবে চোখ ধাঁধাঁনো আলোক সজ্জা দূর থেকে দর্শকদের আকর্ষন করে। গেইট থেকে গাছপালাসহ সবই সাজানো হয় বর্ণোজ্জ্বল আলোকে আলোকিত করে। খুব সুন্দর, সুশৃঙ্খল, বর্ণীল, এবং নিরাপদ থাকে মেলার সার্বিক দিক। নীচে ভিয়েনার মেলার ছবি দিচ্ছি।
ছোট বেলায় আমরা যখন নানা বাড়ী বেড়াতে যেতাম, নানাজান আমাদের সবাইকে পাঘাচং রেলস্টেশন এর কাছাকাছি চিনাইরহাটের মেলায় নিয়ে যেতেন। বাড়ী থেকে বের হওয়ার আগেই ভাল করে বুঝিয়ে নিতেন কি কি করতে হবে, কে কার হাত ধরে রাখবে ইত্যাদি। বাড়ী থেকে হাট বেশী দূরে না, পায়ে হাটার পথ। মেলা দৃষ্টিগোচর হওয়ার সাথে সাথেই ভেসে আসত মেলার নিজস্ব কোলাহল। তারমধ্যে ছিল নানান রকমের বাঁশির সুর যেমন পাতার বাঁশি, বাঁশের
বাঁশি, সাঁপুড়েদের বাঁশি। কানে এখনো বাজে ঢেবঢেবির শব্দ, চরকীর শব্দ, বিক্রি করার জন্য নিয়ে আসা পাখীর কিচিরমিচির, কবুতর-হাঁস-মুরগীর ডাকাডাকি। বাঁশের, বেতের, কাঠের, মাটির এবং লোহার তৈরী হরেক রকমের জিনিষও উঠত তখন মেলায়। নানাজান আমাদেরকে বুট ভাজা, মটর ভাজা, গুড়ের বাতাসা আর মুড়ালী, কিনে দিতেন। টুকরিতে করে নিয়ে আসা খাবারগুলো থাকতো খোলামেলা অসংরক্ষিত। ছোট বড় নানান আকৃতির মাছি ভনভন করে উড়ত আর খাবারে বসত। একটু দাঁড়ালেই পায়ে কামড়ে দিত বিষ পিপড়া। মেলায় যাবার আনন্দের পাশাপাশি ছিল নানান ধরনের পীড়া। সাথে হারিয়ে যাবার ভয় তো ছিলই। তবু মেলা বলতে আমি ঐ গ্রাম্য মেলাকেই বুঝি। আজো অনুভব করি মনের গহীনে লুকিয়ে থাকা নীরব ব্যাথা।