অনামিকার ভাবনা - বিয়াল্লিশ (42)
আমার জাহাঙ্গীরনগর,
আমি জাহাঙ্গীরনগরের !!!
(পর্ব এক)
আমরা কলকাতায় Cecil hotel এ আছি। চার দিন কলকাতায় ঘুরে বেড়াব বলে এসেছি। Breakfast included বলে বের হতে দশটা থেকে সাড়ে দশটা বেজে যায়। আজ আরো কিছু সময় বেশি লেগে গেল গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বর্গের সাথে ফোনালাপের জন্যে। আমাদের বন্ধু ভৌমিক এর সাথে কথা হলো। আবর্তন আট এর পুনঃর্মিলনীতে একটি প্রকাশনার বিষয়ে। লেখাটি আজ রাতের মধ্যে না পাঠাতে পারলে প্রকাশজনিত সমস্যার সৃষ্টি হবে। আমি দুমনা হয়েই শর্তসাপেক্ষে হ্যাঁ বলেছি। ভৌমিক বললো '"প্রবাসে জাহাঙ্গীরনগর" এমন কিছু থাকলে ভালো হয়, তবে আনুমানিক এক পৃষ্ঠার মতো লিখতে পারলেই চলবে। আমি খুব ভালো ভাবেই বুঝতে পেরেছি যে, আমার কষ্ট হবে এমনকি সময়েরও রয়েছে সংকীর্ণতা, এমতাবস্থায় ভৌমিক ছোট করে কিছু একটা লিখতে পারলেই চলবে বলেছে। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে সময়ের অভাবজনিত সমস্যার সাথে সাথে জুড়ে গেছে প্রকাশিতব্য স্মরণিকার পর্যাপ্ত পরিসরের সমস্যাটিও।
আমাদের মাস্টার্স এর ফলাফল প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৬ সালের পঁচিশে ফেব্রুয়ারীতে। আমাদের বিয়ে হয় পহেলা মে ১৯৮৬ সালের শ্রমিক দিবসে।
তপু সিদ্ধান্ত নিলো উচ্চ শিক্ষার জন্য ইউরোপ কিংবা আমেরিকায় যাবে। আমার খালাতো বোন জেবা আপা তাঁর husband অধ্যাপক ডঃ মনিরুজ্জামান এর সাথে দীর্ঘ সময় ধরে ভিয়েনায় ছিলেন। জেবা আপা সব দিক বিবেচনা করে বললেন আমাদের জন্য ভিয়েনা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির চেষ্টা করাই হবে সর্বোৎকৃষ্ট। যদি ভর্তির আবেদন পত্র গৃহীত হয় তবে নিজেদের খরচ চালানোর চিন্তা নিজেদের। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার কোন খরচ নেই বলে মনে হলো যদি Vienna University থেকে zulassazungsschein (ভর্তির অনুমতি পত্র) দেয় তাহলেই আমাদের অনেক কিছু সহজ হয়ে যাবে। Apply করলাম জেবা আপা এবং দুলাভাই ডঃ মনিরুজ্জামান এর সহযোগিতায়। সাথে সাথে নির্ধারিত সময়ের অপেক্ষাও করলাম। জেবা আপা আমার খালাতো ভাই মনির সঙ্গে প্রয়োজনীয় যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন। উল্লেখ্য মনি আমার আপন খালাতো ভাই। ঐ সময়ে এবং আজ অবধি মনি ভিয়েনায় অবস্থানরত। পরিবারের সিদ্ধান্তনুযায়ী তপু পাঁচ মে ১৯৮৬ তারিখে ঢাকা থেকে ভিয়েনামুখী যাত্রা করলো। পৌঁছালো পরের দিন ছয় মে তারিখে। তৎকালীন সময়ে রাশিয়ার এরোফ্লট ছিল সবচেয়ে সস্তা উরালবাহন। বিরতি নিতে হতো প্রথমে নিউ দিল্লিতে এবং পরে মস্কোতে। মস্কোর transit ছিল বেশ কষ্টকর। তৎকালীন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির কাগজ পত্র, ভিয়েনায় বসবাসরত কারো স্পনসর, থাকার নিশ্চিত ব্যবস্থার দলিল, প্রয়োজনীয় ডলার,পাসপোর্ট ও টিকিট সাথে নিয়ে এলেই এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষ সাথে সাথেই ভিসা দিয়ে দিতো। এক্ষেত্রে যাবতীয় কার্যক্রমে মনিকে সহযোগিতা করেছিলেন মরহুম শাহ্ মোহম্মদ ফরহাদ ভাই ( সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সচিব ডঃ শাহ্ মোহম্মদ ফরিদ এর ছোট ভাই।)
ভিয়েনায় বাংলাদেশের বাঙালীর সংখ্যা ছিল হাতে গোনার মতো। মাত্র কয়েকটি পরিবার। জার্মান ভাষা সম্পর্কে ধারণা নেবার সময় হয়নি বলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া, বাসা খুঁজে পাওয়া, কাজের ব্যবস্থা করা ভয়ঙ্কর দুঃশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাছাড়া প্রচন্ড শীতের কষ্টের কথা অবিশ্বাস্য। উল্লেখ্য ১৯৮৭ সালের আট জানুয়ারীতে তাপমাত্রা (-- )২৭ ডিগ্রি
সেলসিয়াস হয়ে গিয়েছিল। তপু ফরহাদ ভাই, শামসুন্নার উল্লাহ ভাবী ( বিএনপির মেজর হাফিজ সাহেবের ছোট বোন।) এবং মনির সহযোগিতায় আমার এবং তপুর নিজের ভর্তির কাজগুলো করে। এসব কাজে তপুর অভিজ্ঞতা পরবর্তীতে নতুন আগতদের আশীর্বাদের দলিল হিসাবে রয়ে যায়। তপু তিন সপ্তাহের মধ্যেই আমার সমস্ত জরুরী কাগজপত্র ও টিকিট পাঠিয়ে দেয়। আমার যাওয়ার দিন নির্ধারিত হলো সেপ্টেম্বর এর তিরিশ তারিখে। ভিয়েনায় পৌছালাম পহেলা অক্টোবর ১৯৮৬ তারিখে। শুরু হলো আমার আর তপুর সংগ্রামী জীবন।
****(লেখাটি জাবি র অষ্টম আবর্তনের বাৎসরিক পুনঃমিলনী স্মরণিকা ২৪ জানুয়ারী ২০২০ তারিখ এ প্রকাশিত হয়েছে।)
নাসরিন নাহীদ
ষোল জানুয়ারী ২০২০
কলকাতার কফি হাউজ থেকে।