অনামিকার ভাবনা - চুয়াল্লিশ (44)

বেনাপোল সীমান্ত থেকে ........

বেনাপোল বাংলাদেশের প্রধানতম স্থল বন্দর। যশোর জেলার শারশাহ উপজেলার অন্তর্ভূক্ত এই স্থল বন্দরটি ১৯৪৭ সাল থেকে আমদানি রপ্তানি ও সাধারণের চলাচল এর জন্য ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় অগণিত বাংলাদেশী ভারতে গমন করেছিল যশোর রোড ধরে  শরণার্থী হয়ে এই বন্দর ধরে। তবে স্বাধীনতার পর থেকে বেনাপোল বন্দরের ব্যবহার যেমন দ্রুততার সাথে বৃদ্ধি পেয়েছে তেমনি প্রয়োজনের তাগিদেই বেনাপোল সীমান্ত শহরের প্রসারতাও ঘটেছে উত্তরোত্তর। কাস্টম এবং ইমিগ্রেশন এর দিক বিবেচনায় দক্ষিণ এশিয়ার সবচাইতে বড় স্থল বন্দর এটি। বলা বাহুল্য যে, বেনাপোল শহরের প্রসারতাও ঘটেছে ঠিক  কাস্টম এবং ইমিগ্রেশন এর উপর নির্ভর করে। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এমন একটি বন্দর শহর না দেখলে কি ভ্রমণ সম্পন্ন হতে পারে?

ভারত ভ্রমণের পরিকল্পনার সাথে সাথে সীমান্ত নিয়ে যে কয়েকটি বিষয় গুরুত্বের সাথে দেখেছিলাম, তন্মধ্যে বেনাপোলের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক ঐতিহ্যবাহী আট নম্বর সেক্টরের সীমান্ত শহরটি ঘুরে দেখা , বিশাল আকৃতির শতবর্ষের পুরনো বৃক্ষরাজির ছায়ায় ঢাকা ঐতিহাসিক যশোর রোড দেখা , সীমান্তবর্তী রেল স্টেশন সহ শহর ও গ্রামের জীবন যাপন অবলোকন করাই ছিল অন্যতম। বাংলাদেশের সাথে ভারতের যোগাযোগ পূর্বের তুলনায় অনেক সহজ হয়েছে। আমার কাছে স্থলপথের রেল যোগাযোগটা খুব আকর্ষণীয় মনে হয়েছে। আগে কখনো বেনাপোলে যাইনি বলে ছোট ভাই নাসির ও বাবুর উপরে নির্ভর করে আছি।

আমরা বনগাঁ স্টেশন থেকে বৃক্ষরাজির ছায়ায় ঘেরা যশোর রোড ধরে পৌছে গেলাম বেনাপোল সীমান্তের কাস্টমস এবং ইমিগ্রেশন ফাড়িতে। ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করবো বলে প্রথমেই আমাদেরকে ভারতীয় সীমান্ত চেকপোস্ট এর যাবতীয় কার্যক্রম সম্পাদন করতে হয়েছে। আন্তরিকতা ও সম্মানের সাথেই চেকিং এর কাজগুলো সম্পন্ন করে দিয়েছেন ভারতীয় কর্মকর্তাগন। একটু সামনে এগিয়ে গেলেই বাংলাদেশের চেকপোস্ট। দূর থেকেই লাইন ধরে এগোচ্ছি। ইনফরমেশন বোর্ডের তথ্যানুযায়ী আমরা বিদেশী পাসপোর্টধারীদের লাইন অনুসরণ করতে থাকলাম। তারিখটি সতেরো জানুয়ারী, যে কারণে বিশ্ব ইজতেমার জন্য বহু ভারতীয় মুসলমান যাচ্ছে টঙ্গীর তোরাগ নদীর তীরে। একদিকে অনেক মানুষের চেকিং অন্যদিকে দিকে কর্মকর্তাদের কাজের ধীরগতি ও অসহনশীল আচরণ আমাদেরকে রীতিমতো ভাবিয়ে তুললো। কিছুই করার নেই, এক পা - দু পা করে লাইন ধরে এগিয়ে যেতে থাকলাম।

দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করে অবশেষে কাউন্টারে সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। সালাম দিয়ে পাসপোর্ট ও অন্যান্য জরুরী কাগজ পত্র দিলাম। পাসপোর্টের রং দেখেই কর্মকর্তা বললেন এই কাউন্টারে লোক নাই। আপনারা সরে দাঁড়ান। পিছনের লোককে জায়গা দেন। আমি বললাম এটা বিদেশী পাসপোর্টধারীদের কাউন্টার। এখানে না হলে আমরা কোথায় যাব? ভদ্রলোক পিছনের দিকে তাকিয়ে তার অধীনস্থ কর্মচারীকে জিজ্ঞাসা করলেন সামনের টেবিলের লোকটি কোথায়? যাও ডেকে নিয়ে আস হুকুম দিয়েই তিনি নিজের কর্তব্য পালন করলেন। তিনি আমাদেরকে বললেন, যান যান সামনের কাউন্টারে যান। আমরা উল্টো দিকের কাউন্টারে গেলাম। বুঝতে পারলাম সেখানেও কাজটি হবে না। যিনি কাউন্টারে ছিলেন তিনি ডান পাশের টেবিল দেখিয়ে বললেন সেখানে অপেক্ষা করতে। আমরা অনিশ্চয়তায় অশান্তি নিয়ে শূন্য চেয়ারটির দিকে তাকিয়ে থাকলাম।

আধ ঘন্টা পর পঞ্চাশ উর্ধ দাঁড়িওয়ালা ঢিলেঢালা শার্ট প্যান্ট পরা এক ভদ্রলোক এলেন। তিনি চেয়ারে বসলেন এবং আমাদের পাসপোর্ট দেখতে চাইলেন। একটি খাতা বের করে কিছু একটা লিখতে গিয়ে উঠে দাঁড়ালেন এবং পাসপোর্ট দুটি হাতে নিয়ে দ্রুত হেঁটে অন্যদিকে চলে গেলেন। আমাদের মনে সন্দেহের সৃষ্টি হলো। লোকটি যেদিকে গেলেন সেদিকে সাধারণের প্রবেশ নিষেধ। আমার কর্তা সাধ্যমত জিজ্ঞাসাবাদ এবং খোঁজাখুঁজির পর দূর থেকে লোকটিকে এবং তার পকেটে পাসপোর্ট দুটি দেখতে পেল। খুব খারাপ লাগছিল। বিরক্তির একেবারে শেষ পর্যায়ে লোকটি এলেন। খাতায় নাম, ঠিকানা ও অন্যান্য তথ্য লিখে এমন একটা ভাব করলেন যেন বিশাল কাজ করে ফেলেছেন। অথচ এই কাজটি আমরা আগরতলা বর্ডার এ নিজেরাই করেছি। মাত্র পাঁচ মিনিটের কাজ। কাজ শেষে আমরা পাসপোর্ট হাতে নিয়ে দ্রুত হাঁটতে শুরু করলাম। লোকটি নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য ফেলে পিছু নিল আমাদের। পরিষ্কার বুঝতে পারলাম কিছু চাওয়া এবং পাওয়ার উদ্দেশ্য তার। কেন এমন অবস্থা? একটি ইমিগ্রেশন অফিসে এতটা অনিয়ম, কাজের প্রতি অনীহা, কাজের ধীরগতি, অশ্রদ্ধাশীল ব্যবহার কোন কিছুই ঠিক মনের মধ্যে কাঁটার মতো বিঁধে আছে।

আমরা যদি নিজেরাই নিজেদের নৈতিকতা ঠিক না করি কিভাবে হবে নিজের তথা দেশের উন্নতি। দেশটা আমাদের সবার। কাজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে, নিষ্ঠার সাথে সবাইকে আন্তরিকভাবে অবশ্যই কাজ করে যেতে হবে, যার কোন বিকল্প নেই। সারাটা পৃথিবী চলছে give and take হিসেবে। বেতন ভোগের পরিবর্তে অবশ্যই সেবা প্রদান করতে হবে। সরকার তথা জনগণকে ঠকানোর অর্থ হলো নিজেকে ঠকানো।

অতিসত্তর সরকারের নিয়ন্ত্রণ এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরী বলে মনে করছি।

নাসরিন নাহীদ

পঁচিশ মার্চ ২০২০

Next
Next

অনামিকার ভাবনা - তেতাল্লিশ (43)